শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:০৩ পূর্বাহ্ন
কক্সবাজার সাগরপারের দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী আশিকুল ইসলাম আশিক এমনই ভয়ংকর যে, তাঁর কবল থেকে পুলিশ সদস্যেরও রেহাই মেলেনি। পুলিশ বাহিনীকেও তিনি কলঙ্কিত করে ছেড়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। সাগরপারের লাইট হাউস এলাকার কটেজ জোনের পতিতা ডেরায় ট্যুরিস্ট পুলিশের এক সদস্যকে ধরে নিয়ে পতিতার সাথে বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণের পর তাঁর (পুলিশ সদস্য) কাছ থেকে আশিক হাতিয়ে নিয়েছেন মোটা অঙ্কের টাকা। তার পরও সন্ত্রাসী আশিকের বিরুদ্ধে পুলিশ ছিল একপ্রকার নির্বিকার।
দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী আশিকের এমন পিলে চমকানো অপকর্মের তথ্য মিলেছে রবিবার কক্সবাজার ট্যুরিস্ট পুলিশ আয়োজিত প্রেস ব্রিফিং অনুষ্ঠানেই। ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ট্যুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক (অতিরিক্ত ডিআইজি) মোহাম্মদ মুসলিম। তিনি পর্যটক নারী ধর্ষণের প্রধান আসামি আশিকের নানা অপকর্মের তথ্য জানার জন্য সহযোগিতা চাইলে উপস্থিত গণমাধ্যমকর্মীরা এমন চাঞ্চল্যকর বিষয়টি তুলে ধরেন। এ সময় উপস্থিত কক্সবাজার ট্যুরিস্ট পুলিশের পুলিশ সুপার মো. জিললুর রহমানের নিকট অতিরিক্ত ডিআইজি জানতে চাইলে তিনি আগের দিন এ বিষয়টি শুনেছেন বলে জানান।
পর্যটক নারী ধর্ষণের ঘটনায় জড়িত পুলিশ তিন সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার বিষয়ে অবহিত করার জন্যই ট্যুরিস্ট পুলিশ প্রেস ব্রিফিংটির আয়োজন করে। অতিরিক্ত ডিআইজি মুসলিম জানান, গত ২২ ডিসেম্বর রাতে সন্ত্রাসী আশিকের নেতৃত্বে স্বামী ও দুগ্ধপোষ্য শিশুকে আটকে রেখে পর্যটক নারীকে অপহরণপূর্বক দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় রুজু করা মামলায় রবিবার ভোরে তিন সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করা হয়। ধর্ষিতা নারীর স্বামী মামুন মিয়ার দায়ের করা ওই মামলায় চারজনের নাম উল্লেখ করে আরো তিনজনকে অজ্ঞাতপরিচয় বলা হয়েছিল। এ তিনজনই সেই অজ্ঞাতপরিচয় আসামি বলে তিনি জানান।
অতিরিক্ত ডিআইজি বলেন, এজাহারে তিনজনের নাম না থাকলেও ওই নারী আদালতে প্রদত্ত ২২ ধারায় তাদের নাম উল্লেখ করেন।
ট্যুরিস্ট পুলিশের পুলিশ সুপার মো. জিললুর রহমানের নেতৃত্বে কক্সবাজার শহরের বাইরে পরিচালিত অভিযানে গ্রেপ্তার হওয়া সন্ত্রাসীরা হচ্ছে যথাক্রমে স্থানীয় বাহারছড়া এলাকার রেজাউল করিম (২৬), চকরিয়ার ডুলাহাজারা এলাকার বাসিন্দা মামুনুর রশীদ (২৮) ও বাহারছড়ার মেহেদী হাসান (২৫)। এর আগে ঘটনার রাতে র্যাব সদস্যরা জিয়া গেস্ট ইন ম্যানেজার রিয়াজুদ্দিন ছোটনকে আটক করেছিল। এ নিয়ে মামলার চার আসামি গ্রেপ্তার হলো। জিয়া গেস্ট ইন ম্যানেজার ছোটনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য চার দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। পুলিশ সুপার জানান, রিমান্ডে থাকা হোটেল জিয়া গেস্ট ইন ম্যানেজার ছোটন এবং আশিক দুজন বাল্যবন্ধু।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কক্সবাজার সৈকত তীরের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে রয়েছে সন্ত্রাসী আশিক বাহিনীর রাজত্ব। আশিকের বাহিনীতে রয়েছে ৩২ জনের সন্ত্রাসী। সন্ত্রাসী আশিক যেখানে হানা দেন সেখানে টর্নেডোর মতো কয়েক মিনিটেই ম্যাসাকার করে ফেলেন। তাই সাগরপারের ‘টর্নেডো’ হিসেবেই তিনি পরিচিত। এমন দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী আশিক যদি আবারও মাঠে ফিরে আসেন তাহলে এবার কারো রক্ষা নেই—এমন ভীতি বিরাজ করছে পর্যটনসংশ্লিষ্ট লোকজনের মধ্যে।
আশিক দীর্ঘদিন ধরে সাগরতীরে সন্ত্রাসের রাজত্ব চালিয়ে এলেও সবাই নীরবে সহ্য করে গেছে। তবে গত বুধবার রাতে পর্যটন নারী ধর্ষণের ঘটনার পর থেকে গাঢাকা দেওয়া সন্ত্রাসী আশিকের অজানা তথ্য ফাঁস হতে শুরু করেছে। তাও অনেকেই মুখ খুলছেন একদম গোপনে এবং নাম প্রকাশ না করার শর্তে। কেননা আশিক যদি এলাকায় ফিরে আসার সুযোগ পান তাহলে পর্যটন ব্যবসায়ীদের এলাকাছাড়া করে দেবেন। আশিক সাগরপারের অত্যন্ত চালাক সন্ত্রাসী বলে এলাকায় চাউর রয়েছে। তাঁর টাকা রোজগারের পথ সুগম করার জন্য যা যা করার দরকার তা-ই করতেন তিনি।
সাগরপারের লাইট হাউস এলাকার কটেজ জোনের কয়েকটি কটেজকেন্দ্রিক রয়েছে দেহ ব্যবসার ডেরা। সেই ডেরার অর্ধশতাধিক দেহ ব্যবসায়ী নারীর অবৈধ রোজগারের একটি বড় অংশ যায় সন্ত্রাসী আশিকের পকেটে। ডেরাটি ঘিরে রয়েছে অনেক অজানা কথা। জানা গেছে, আশিক যাতে নিরাপদে তাঁর রাজ্যে বিচরণ করতে পারেন সে জন্য তিনি বাছাই করে ‘পথের কাঁটা’ দূর করার কাজগুলোই আগেভাগে সেরে ফেলতেন। এ জন্যই তিনি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীরও কোনো কোনো সদস্যকে দেহ ব্যবসার ডেরায় ফাঁদে ফেলে এমনই প্রমাণযোগ্য ভিডিও ধারণ করে রেখেছেন, যাতে তাঁর (আশিক) দিকে কোনোভাবেই আঙুল প্রদর্শন করতে না পারেন। আবার এ কাজ করে ভাইরাল করার ভয় দেখিয়ে টাকাও আদায় করেছেন।
ওই ডেরার সাথে জড়িত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক যুবক জানান, কক্সবাজার সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের পূর্ব পাশের বেশ কয়েকটি কটেজকেন্দ্রিক গড়ে ওঠা দেহ ব্যবসার ডেরায় সন্ত্রাসী আশিক ‘টর্নেডো’ হিসেবেই পরিচিত। ডেরার লোকজন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কোনো সদস্যকে ভয় পায় না, ভয় কেবল টর্নেডোকে। আশিক মোটরবাইকের বহর নিয়ে আকস্মিক ডেরায় হানা দেন। সাথে থাকে বাহিনীর ১০-১২ জন সদস্য। আশিক ডেরায় আকিস্মক হানা দিয়ে টর্নেডোর মতো করে ছোবল মেরে সব তছনছ করে দেন বলেই তাঁকে টর্নেডোর সাথে তুলনা করা হয়।
আকস্মিক তছনছ করে আতঙ্ক ছড়ানোর পর কটেজের প্রতিটি কক্ষে তল্লাশি চালিয়ে দেহ ব্যবসায় জড়িত নারীদের জমানো টাকা-পয়সা, স্বর্ণালংকারসহ মূল্যবান জিনিসপত্র হাতিয়ে নেন। এখানকার ডেরায় রয়েছেন অর্ধশতাধিক নারী। তাঁদের মধ্যে পছন্দের নারীকে আশিক গত বুধবার রাতে পর্যটক নারী অপহরণের ঘটনার মতো করে বাইকে তুলেই নিয়ে যান। পছন্দের নারীদের ছবি ভিডিও করে নিয়ে ভাইরাল করার হুমকি দিয়ে অর্থ হাতিয়ে নেন। ‘টর্নেডো’ হিসেবে পরিচিত আশিকের সামনে কারো সাধ্য নেই প্রতিবাদ করার। আবার ডেরাটি টিকেও রয়েছে সন্ত্রাসী আশিকের সহযোগিতায়।
শহরের গণপূর্ত বিভাগের অফিসসংলগ্ন এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় রয়েছে ডেরাটি। ডেরাটি সম্পর্কে যাঁরা জানেন তাঁরা সেই রাস্তা দিয়ে চলাচল করেন না। কেননা ডেরার লোকজন যেকোনো পথচারীকে টেনে কটেজে ঢুকিয়ে ফেলার অভিযোগ রয়েছে। এমন গুরুত্বপূর্ণ এলাকাটির ডেরা সম্পর্কে কক্সবাজার সদর মডেল থানা এবং ট্যুরিস্ট পুলিশ সবই জানে কিন্তু এসবে অভিযান হয় না। পুলিশের অভিযান না হওয়ার নেপথ্যে কোনো কোনো বাহিনী সদস্যদের ভিডিও ভাইরাল করে দেওয়ার ভীতি কাজ করছে বলে অনেকের ধারণা। সৈকততীরের ইয়াবাসহ মাদকের রাজ্যও সন্ত্রাসী আশিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।